০৩:০২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ জুন ২০২৫, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব।

বিশ্বজিৎ চন্দ্র সরকার, বিশেষ প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ফসলি জমি, খাল এবং রেল-সড়কের পাশে বেড ভরাটের নামে দিনে-দুপুরে নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে সিলিকা বালু। এতে ধসে পড়ছে জমি, নিঃস্ব হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো এবং হারিয়ে যাচ্ছে জীবিকার উৎস।

সরেজমিনে ভয়াবহ চিত্র:
মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে কাশিয়ানী উপজেলার সিংগা ইউনিয়নের রামবাজার এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ড্রেজার দিয়ে ৫০ থেকে ১৫০ ফুট গভীর করে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এলাকাজুড়ে চলছে ভরাটের কাজ, বসানো হয়েছে একাধিক মেশিন।

এছাড়াও রাজপাট, পুইশুর, হাতিয়াড়া, রাহুথড়, মাহমুদপুর, সোনাডাঙ্গা, খাগড়াবাইড়, কুমরিয়া, শ্রীপুর উত্তরপাড়া ও গোয়ালগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চলছে এই অবৈধ কার্যক্রম।

অদৃশ্য ছায়ার পৃষ্ঠপোষকতা:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “অদৃশ্য এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় রাস্তাঘাট, খাল ও ফসলি জমিতে চলছে বালু উত্তোলন।” অভিযোগ রয়েছে, এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিংগা ইউনিয়নের শরোজিত কর, লালু, এবং রাজপাট ইউনিয়নের ছারু ও রুবেল। এদের সহযোগিতায় রাজু মোল্লা নামক এক বালু ব্যবসায়ী সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন।

আন্দারকোটায় স্বৈরাচারী কন্টাক্টরের জবরদখল:

সিংগা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের আন্দারকোটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণ করছেন এক স্বঘোষিত কন্টাক্টর আলম। স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এই কাজ শুরু করেছেন তিনি। এর ফলে জমির মালিকেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আইন ও ন্যায়ের প্রতি মানুষের আস্থাও দুর্বল হচ্ছে।

এই ঘটনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সত্যতা যাচাই করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং প্রশাসনকে অবগত করলেও এখনো পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

কৃষকদের হাহাকার:
স্থানীয় কৃষক রঞ্জিত বলেন, “জমি নিচু হয়ে যাচ্ছে। ফসল ফলানো যাচ্ছে না। প্রশাসনের চোখের সামনে এত বড় অন্যায় চলছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই।”

ভুয়া পরিচয়ে সাংবাদিকতা ও হয়রানি:
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিছু নামধারী সাংবাদিক অবৈধ উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে তাদের কাজের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজেদের ইউএনও বা এসি ল্যান্ডের লোক পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
গত ২৮ মে রামবাজার এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের সময় মো. রুবেল-এর সাইটে তিনজন সাংবাদিক নিজেদের এসি ল্যান্ড অফিসের লোক পরিচয় দেন। এ সময় “শমোর” নামের এক বৃদ্ধ আতঙ্কে দৌড় দিতে গিয়ে গুরুতর আহত হন।

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা:
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, একাধিকবার উপজেলা ভূমি অফিস ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রাজপাট ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) অধীর মন্ডল বলেন, “আমরা নিষেধ করেছি, কিন্তু তারা গোপনে আবার শুরু করে। বিষয়টি এখনো উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি।”

প্রশাসনের আশ্বাস:
কাশিয়ানী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনমুন পাল বলেন, “ফসলি জমি ভরাট ও বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

📌 সম্পাদকীয় মন্তব্য:
যেখানে পরিবেশ, কৃষি জমি, এবং মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে, সেখানে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলা অমার্জনীয়। স্বার্থান্বেষী একটি চক্রের হাতে একটি অঞ্চল জিম্মি হয়ে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এর প্রতিরোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় পোস্ট

বটিয়াঘাটা গোসলের সময় পানিতে এক শিশুর মৃত্যু।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব।

আপলোডের সময় ০৪:২৪:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১১ জুন ২০২৫

বিশ্বজিৎ চন্দ্র সরকার, বিশেষ প্রতিনিধি

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ফসলি জমি, খাল এবং রেল-সড়কের পাশে বেড ভরাটের নামে দিনে-দুপুরে নির্বিচারে উত্তোলন করা হচ্ছে সিলিকা বালু। এতে ধসে পড়ছে জমি, নিঃস্ব হচ্ছে কৃষক পরিবারগুলো এবং হারিয়ে যাচ্ছে জীবিকার উৎস।

সরেজমিনে ভয়াবহ চিত্র:
মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে কাশিয়ানী উপজেলার সিংগা ইউনিয়নের রামবাজার এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ড্রেজার দিয়ে ৫০ থেকে ১৫০ ফুট গভীর করে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। এলাকাজুড়ে চলছে ভরাটের কাজ, বসানো হয়েছে একাধিক মেশিন।

এছাড়াও রাজপাট, পুইশুর, হাতিয়াড়া, রাহুথড়, মাহমুদপুর, সোনাডাঙ্গা, খাগড়াবাইড়, কুমরিয়া, শ্রীপুর উত্তরপাড়া ও গোয়ালগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে চলছে এই অবৈধ কার্যক্রম।

অদৃশ্য ছায়ার পৃষ্ঠপোষকতা:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “অদৃশ্য এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় রাস্তাঘাট, খাল ও ফসলি জমিতে চলছে বালু উত্তোলন।” অভিযোগ রয়েছে, এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সিংগা ইউনিয়নের শরোজিত কর, লালু, এবং রাজপাট ইউনিয়নের ছারু ও রুবেল। এদের সহযোগিতায় রাজু মোল্লা নামক এক বালু ব্যবসায়ী সক্রিয়ভাবে জড়িত রয়েছেন।

আন্দারকোটায় স্বৈরাচারী কন্টাক্টরের জবরদখল:

সিংগা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের আন্দারকোটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণ করছেন এক স্বঘোষিত কন্টাক্টর আলম। স্থানীয়দের অভিযোগ, কোনো সরকারি অনুমোদন ছাড়াই এই কাজ শুরু করেছেন তিনি। এর ফলে জমির মালিকেরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি আইন ও ন্যায়ের প্রতি মানুষের আস্থাও দুর্বল হচ্ছে।

এই ঘটনায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় সাংবাদিকদের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সত্যতা যাচাই করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এবং প্রশাসনকে অবগত করলেও এখনো পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

কৃষকদের হাহাকার:
স্থানীয় কৃষক রঞ্জিত বলেন, “জমি নিচু হয়ে যাচ্ছে। ফসল ফলানো যাচ্ছে না। প্রশাসনের চোখের সামনে এত বড় অন্যায় চলছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেই।”

ভুয়া পরিচয়ে সাংবাদিকতা ও হয়রানি:
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিছু নামধারী সাংবাদিক অবৈধ উত্তোলনকারীদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে তাদের কাজের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। কেউ কেউ নিজেদের ইউএনও বা এসি ল্যান্ডের লোক পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।
গত ২৮ মে রামবাজার এলাকায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের সময় মো. রুবেল-এর সাইটে তিনজন সাংবাদিক নিজেদের এসি ল্যান্ড অফিসের লোক পরিচয় দেন। এ সময় “শমোর” নামের এক বৃদ্ধ আতঙ্কে দৌড় দিতে গিয়ে গুরুতর আহত হন।

প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা:
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, একাধিকবার উপজেলা ভূমি অফিস ও প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
রাজপাট ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) অধীর মন্ডল বলেন, “আমরা নিষেধ করেছি, কিন্তু তারা গোপনে আবার শুরু করে। বিষয়টি এখনো উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়নি।”

প্রশাসনের আশ্বাস:
কাশিয়ানী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনমুন পাল বলেন, “ফসলি জমি ভরাট ও বালু উত্তোলন সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

📌 সম্পাদকীয় মন্তব্য:
যেখানে পরিবেশ, কৃষি জমি, এবং মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে, সেখানে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও অবহেলা অমার্জনীয়। স্বার্থান্বেষী একটি চক্রের হাতে একটি অঞ্চল জিম্মি হয়ে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এর প্রতিরোধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।